লুইস ক্যারলের “অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড” বইটা অনেকেই পড়েছেন। তিনি কেবল ঔপন্যাসিক নন, গণিতবিষয়ক বিভিন্ন ধাঁধাও তিনি তৈরি করেছেন। প্রথম ছবির ডানদিকে লুইস ক্যারলের একটা ধাঁধার ছবি দেওয়া আছে। এই ছবিটা একবারও কলম না তুলে এবং কোন লাইনের ওপর একবারের বেশি দাগ না দিয়ে একটানে আঁকতে হবে।
কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর সমাধান করতে না পেরে আপনি যদি ভাবেন, এটা হয়ত সম্ভব না, তাহলে এই লেখাটা পড়ে নিন। কারণ কখন একটি ছবি একটানে আঁকা যাবে আর কখন যাবে না, সেই গণিত নিয়েই আজকের আলোচনা। গণিত নিয়ে যারা একটু-আধটু পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই নীরস পাটিগণিত আর জ্যামিতির উপপাদ্যের বাইরেও অনেক কিছুই পেয়েছেন। গণিতে এরকম একটা শাখার নাম গ্রাফ থিওরি ও টপোলজি। সেখানকার একদম বেসিক আলোচনা হল একটানে ছবি আঁকা।
কনিসবার্গ নামে রাশিয়ায় একটা শহর আছে। এর দুইপাশ দিয়ে প্রেগেল নদী এমনভাবে বয়ে গেছে যে, মাঝ বরাবর দুটি দ্বীপ জেগে উঠেছে, ম্যাপের ছবিটা দেখলেই বুঝতে পারবেন। নদীর দুইপাশে আর দুটি দ্বীপ নিয়ে এই শহরের চারটি অংশ মোট সাতটি সেতু দিয়ে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করে আছে। যখনকার গল্প বলছি, তখন অবশ্য কনিসবার্গ জার্মানির অন্তর্ভূক্ত ছিল। সেখানকার মেয়রের হঠাৎ করে জানতে ইচ্ছে হলো, কীভাবে এই সবগুলো সেতু সব একবার করে পার করা যাবে যেন কোন সেতুর ওপর দিয়ে দুবার যেতে না হয়। অনেক ভেবে তিনি গণিতবিদ অয়লারের কাছে খবর পাঠালেন।
আচ্ছা, আমরা একবার চেষ্টা করে দেখি। আমরা শহরগুলোর নাম দিই লাল, নীল, হলুদ, সবুজ আর সেতুগুলোর নাম দিই ১, ২, ৩… ৭। মনে করুন, আপনি লাল শহর থেকে ১ সেতু দিয়ে দিয়ে নীল, সেখান থেকে ৫ দিয়ে সবুজ, ৬ দিয়ে নীল, ২ দিয়ে লাল, ৪ দিয়ে হলুদ, ৭ দিয়ে সবুজ শহরে গেলেন। কিন্তু ৩ নম্বর সেতুটা বাদ রয়ে গেল, এদিক দিতে যেতে হলে আপনাকে আবার ৬ নম্বর ব্রিজ দিয়ে যেতে হবে। আপনি আরও দুয়েকভাবে চেষ্টা করতে পারেন। যদি সমাধান পেয়ে যান, আপনাকে অভিনন্দন, আপনি সাফল্যের সাথে কোথাও ভুল করে ফেলছেন!
শুরুতে এই প্রশ্নের কোন কূলকিনারা না পেয়ে অয়লার চিঠি পাঠালেন তাঁর ইতালিয়ান এক গণিতবিদ বন্ধুর কাছে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “The question is so banal but seemed to me worthy of attention in that [neither] geometry nor algebra, nor even the art of counting was sufficient to solve it.” পরবর্তীতে অবশ্য এই সমস্যার সমাধান তিনি নিজেই করেছিলেন এবং এর মাধ্যমে তাঁর হাত ধরে জন্ম নেয় গ্রাফ থিওরি ও টপোলজির মত অতি প্রয়োজনীয় গণিতের এক শাখা। সমাধানটা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।
প্রথমে আমরা কনিসবার্গের ম্যাপটা আমাদের নিজেদের মত সাজিয়ে নিই। দ্বিতীয় ছবিটা দেখলেই বুঝবেন, আমরা কীভাবে চারটি শহরকে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ বিন্দু দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছি, আর সেতুগুলোকে একেকটা বক্ররেখা বানিয়ে ফেলেছি। এখন ব্রিজের ওপর দিয়ে মানুষ যাওয়া আর কলম যাওয়া আসলে একই কথা। তাহলে বুঝতেই পারছেন, এখন আমাদের সমস্যাটা হল, কী করে ডানপাশের ছবিটা একবারও কলম না তুলে একটানে আঁকা যায়।
এবার আসুন, কিছু কেতাবি বিষয় শিখে নিই। প্রথমেই আমাদের জানতে হবে Node (প্রান্তবিন্দু/নোড) আর Edge (বাহু) কী জিনিস। এখানে একেকটা ব্রিজ হলো একেকটা বাহু, আর যেখানে একাধিক ব্রিজ মিলিত হয়েছে, অর্থাৎ শহরগুলো হলো নোড। আরেকভাবে বললে, যেকোন দুটি নোডের সংযোগরেখাই বাহু, আর একাধিক সংযোগরেখার ছেদবিন্দু নোড। আরেকটা বিষয় জানতে হবে, তা হলো নোডের ডিগ্রী। ডিগ্রী মূলত দুই প্রকার, জোড় আর বেজোড়। যদি কোন নোডে জোড়সংখ্যক বাহু মিলিত হয়, সেটা জোড় নোড। আর বেজোড়সংখ্যক বাহু মিলিত হলে সেটা বেজোড় ডিগ্রীর নোড। এখন চট করে চিন্তা করুন তো, কনিসবার্গের সেতু সমস্যায় কোন নোডের প্রকৃতি কীরকম। নীল নোডে পাঁচটি বাহু মিলিত হয়েছে আর বাকি সব নোডেই তিনটি করে বাহু মিলিত হয়েছে। অর্থাৎ এখানে সবগুলো নোডই বেজোড় ডিগ্রীর নোড।
এখন আপনি সহজেই বুঝতেই পারবেন, জোড় নোড আপনি সহজেই একটানে আঁকতে পারবেন। কারণ আসার পথ আর যাওয়ার পথ এখানে জোড়ায় জোড়ায়। কিন্তু বেজোড় নোড কখনো কখনো আঁকা যায়, কখনো যায় না। এখানেই অয়লারের খেলা। অয়লার প্রমাণ করে ফেললেন, এরকম কোন ছবি একটানে আঁকা যাবে না, যেখানে দুইয়ের বেশি বেজোড় নোড আছে। যত ইচ্ছা জোড় নোড থাকুক, একটা বা দুটো বেজোড় নোড থাকুক, সব আঁকা যাবে। কিন্তু তিন বা তার বেশি বেজোড় নোড হয়ে গেলেই সমস্যা!
যেহেতু কনিসবার্গের সেতু সমস্যায় চারটি বেজোড় নোড আছে, তাই এর সমাধান হলো কোন সমাধান নেই!
অয়লারের এই উপপাদ্যকে বলা হয় গ্রাফ থিওরির প্রথম উপপাদ্য। আর যেসব ছবি একটানে আঁকা যায়, সেগুলোকে বলা হয় অয়লার চক্র। এই কাজটি প্রথম ১৭৩৫ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ একাডেমিতে “The Solution of a Problem Relating to Geometry of Position” শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
তাহলে এখন চিন্তা করুন দেখি, তিন নম্বর ছবির কোনগুলো একটানে আকঁতে পারবেন? যেগুলো আঁকা যাবে, সেগুলো কীভাবে আঁকা যাবে?
গ্রাফ থিওরি আর টপোলজির ব্যবহার আজকাল বিস্তর। কম্পিউটার নেটওয়ার্কে এর ব্যবহার প্রায় সব জায়গায় চোখে পড়ে। টপোলজির আরেকটা বিখ্যাত সমস্যা আছে, বিশ্বের মানচিত্রে কমপক্ষে কতগুলো রং ব্যবহার করলে পাশাপাশি কোন দেশের রং একই হবে না? এর উত্তর এখনো কোন মানুষ বের করতে পারে নি। উচ্চস্তরের কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করে দেখা গেছে কমপক্ষে চারটি ভিন্ন রং দরকার। আগ্রহীরা এ ব্যাপারে একটু খোঁজ করলেই বিস্তারিত জানতে পারবেন।
আরেকটা বিষয়, এটি লিখে বোঝানো সম্ভব না, কিন্তু এত চমৎকার, যে না উল্লেখ করে পারছি না। টপোলজিতে একধরণের বিশেষ স্ট্রিপ (লুপ) আছে, এর নাম মোবিয়াস স্ট্রিপ। এই লুপের বিশেষত্ব হলো, মাঝ বরাবর কাটলে এটি দুই ভাগ না হয়ে আরও বড় একটা লুপ হয়ে যায়! অনেকটা ম্যাজিকের মতো! যেহেতু এখন কারও তেমন কাজ নেই, তাই আমি প্রথম কমেন্টে ইউটিউবে Numberphile এর একটি লিংক দিয়ে দিচ্ছি, যেখানে অত্যন্ত চমৎকারভাবে মোবিয়াস লুপ এবং একাধিক মোবিয়াস লুপ মিলে কীভাবে হার্ট শেপ কিংবা বর্গ হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়টা দেখানো আছে। আগ্রহীরা দেখে নেবেন এবং এটা বাড়িতেও খুব সহজে করে মানুষজকে তাক লাগিয়ে দিতে পারবেন!
কনিসবার্গের এই সাতটি সেতুর বর্তমান অবস্থা জানিয়ে শেষ করে দিই। সাতটি সেতুর মধ্যে দুটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়, দুটি রাশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্পের আওতায় নতুন করে তৈরি করা হয়েছে, আর বাকি তিনটি প্রাচীন সেতু এখনও অক্ষত রয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
১। কম্বিনেটোরিক্সে হাতেখড়ি – আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরি
২। প্রাণের মাঝে গণিত বাজেঃ জ্যামিতির জন্য ভালোবাসা (এখানে খুবই বিস্তারিত এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা আছে) – সৌমিত্র চক্রবর্তী
৩। নিউরণে অনুরণন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও মোহাম্মদ কায়কোবাদ
৪। উইকিপিডিয়া
৫। নাম্বারফাইল ইউটিউব চ্যানেল

Comments

Popular Posts